বন একটি দেশের মূল্যবান সম্পদ । আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সরকারি হিসাব মতে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বনভূমির আয়তন প্রায় ২২.৫ লক্ষ হেক্টর । বনভূমির এ পরিমাণ দেশের মোট ভূমির শতকরা ১৭ ভাগ । এই বন সারাদেশে সমানভাবে বিস্তৃত নয় । অধিকাংশ বনভূমি দেশের পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত । দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বনভূমির পরিমাণ খুবই কম ।
অবস্থান ও বিস্তৃতিভেদে বাংলাদেশের বনাঞ্চলের ধরন
বনভূমির অবস্থান ও বিস্তৃতি অনুসারে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত পাঁচভাগে ভাগ করা হয়েছে । ভাগগুলো হলো-
১। পাহাড়ি বন ২। সমতলভূমির বন ৩। ম্যানগ্রোভ বন ৪ । সামাজিক বন ৫। কৃষি বন
নিচের ছকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ দেখানো হলো-
অবস্থান ও বিস্তৃতিভেদে বাংলাদেশের বনাঞ্চল (লক্ষ হেক্টর)
বনের ধরন | প্রাকৃতিক বন | কৃত্রিম বা সৃজিত বন | মোট |
পাহাড়ি বন | ১১.০৬ | ২.১০ | ১৩.১৬ |
ম্যানগ্রোভ বন | ৬.১৬ | ১.৩৪ | ৭.৫০ |
সমতল ভূমির বন | ০.৮৭ | ০.৩৬ | ১.২৩ |
গ্রামীণ বন | ২.৭০ | ২.৭০ |
বনাঞ্চলের ধরন ও বৈশিষ্ট্য
পাহাড়ি বন
আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি বন অবস্থিত। বাংলাদেশের বন এলাকার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে পাহাড়ি বন। কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভী বাজারে এ বন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ভারত
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান পাহাড়ি গাছ হচ্ছে- গর্জন, রাজকড়ই, চাপালিশ, তেলসুর, কড়ই, গামার, চম্পা, জারুল, সেগুন, বন্য আম প্রভৃতি। পাহাড়ি বন এলাকায় নানা ধরনের বাঁশও জন্মে থাকে। এসব বাঁশের মধ্যে বরাক, মূলী, উরা, মরাল, তল্লা, কেইট্টা, নালা প্রভৃতি । পাহাড়ি বনাঞ্চলে হাতি, বানর, শুকর, ভালুক, বনমুরগি, শিয়াল, নেকড়ে, কাঠবিড়ালি প্রভৃতি বন্য প্রাণী বাস করে। বিভিন্ন রকমের পাখি ও কীট পতঙ্গ পাহাড়ি বনাঞ্চলে দেখা যায়। বড় বড় গাছপালা ছাড়াও লতা- গুন্মসহ অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ পাহাড়ি বনাঞ্চলে জন্মে থাকে । দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশের উপর পাহাড়ি বনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এ বনের পরিমাণ ১৩.১৬ লক্ষ হেক্টর ।
সমতলভূমির বন
বৃহত্তর ঢাকা, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও কুমিল্লা অঞ্চলের বনকে সমতল ভূমির বন বলে । এ বনের প্রধান প্রধান বৃক্ষ শাল ও গজারি, এছাড়া কড়ই, রেইনট্রি, জারুল ইত্যাদি বৃক্ষও এ বনে জন্মে থাকে । সমতলভূমির প্রাকৃতিক বনের কাছাকাছি বসতি থাকায় এ বনের উপর মানুষের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে । ইতোমধ্যে অনেক স্থান বনশূন্য হয়ে পড়েছে । সরকারিভাবে এসব এলাকায় সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জনগনের অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে কোনো কোনো স্থানে সামাজিক বনায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এ বনের শাল কাঠ খুবই উন্নতমানের হয়ে থাকে । গৃহ নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি ও অন্যান্য নির্মাণ কাজে শাল কাঠের ব্যবহার করা হয় । এ বনের বন্য প্রাণী প্ৰায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে কোথাও কোথাও অল্প সংখ্যক নেকড়ে, হরিণ, বানর, সাপ, ঘুঘু, দোয়েল ও শালিক দেখা যায়। এ বনের মোট পরিমাণ ১.২৩ লক্ষ হেক্টর ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এ বন অবস্থিত। প্রত্যহ সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে এ বন প্লাবিত হয় বলে একে লোনা পানির বনও বলা হয়। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার দক্ষিণের বিস্তৃত এলাকা ম্যানগ্রোভ বলে পরিচিত। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরি । সুন্দরি বৃক্ষের নামানুসারে এ বনের নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন । এ বনের অধিকাংশ উদ্ভিদের উর্ধ্বমুখী বায়বীয় মূল রয়েছে। যার সাহায্যে এরা শ্বসন ক্রিয়ার জন্য অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে । কারণ জলাবদ্ধ মাটি থেকে সাধারণ মূলের পক্ষে অক্সিজেন গ্রহণ সম্ভব নয়। এ বনের গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষ হলো- গেওয়া, গরান, পশুর, কেওয়া, বাইন, কাকড়া, গোলপাতা ও মোটা বেত । বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এ বনে বাস করে । চিতাবাঘ, হরিণ, বানর, অজগর, বিচিত্র রকমের পাখি ও কীট-পতঙ্গ এ বনে বাস করে। সুন্দর বনের নদী ও খালে কুমির ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বাস করে । প্রতি বছর সুন্দরবন থেকে প্রচুর মধু ও মোম পাওয়া যায় । সুন্দরবন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বন । পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বড় ও সম্পদশালী ম্যানগ্রোভ বন হলো সুন্দরবন । এ বনের মোট আয়তন ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার ।
বাংলাদেশের ৩টি জায়গায় ম্যানগ্রোভ বনভূমি রয়েছে। যথা- ১। চকোরিয়া সুন্দরবন ২। টেকনাফ উপকূল ৩। বৃহত্তর খুলনার সুন্দরবন ।
গ্রামীণ বন: বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে গ্রামীণ বন রয়েছে, মানুষ বসতভিটা, পুকুর, নদী ও অন্যান্য জলাশয়ের পাশে এসব বন গড়ে তোলে ।
কাজ - ১ বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নিচের ছকের কাজটি পোস্টারে লিখে উপস্থাপন করবে ।
বনের নাম | অবস্থান | উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ | বসবাসকারী প্রাণী |
১। পাহাড়ি বন | |||
২। সমতল ভূমির বন | |||
৩। ম্যানগ্রোভ বন |
কাজ - ২ শিক্ষার্থীরা মানচিত্র দেখে বিভিন্ন বনের অবস্থান চিহ্নিত করবে । |
বনভূমিতে মজুদ কাঠের পরিমাণ
জরীপ ও সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বনভূমিতে মজুদ কাঠের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়ে থাকে । বনে মজুদ থাকা কাঠের পরিমাণকে গ্রোয়িং স্টক বলা হয় । এই গ্রোয়িং স্টক এর পরিমাণের উপর ভিত্তি করেই বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় । বিভিন্ন বনভূমিতে সমীক্ষায় প্রাপ্ত কাঠের পরিমাণ নিচে ছক আকারে দেওয়া হলো ।
বন ভূমিতে মজুদ কাঠের পরিমাণ
বনের ধরন | মজুদ কাঠের পরিমাণ মিলিয়ন* ঘন মিটার |
পাহাড়ি বন | ২০.৭১ |
ম্যানগ্রোভ বন | ১২.৩২ |
সমতল ভূমির বন | ১.২০ |
গ্রামীণ বন | ৫৪.৬৮ |
মোট | ৮৮.৯১ |
* মিলিয়ন = ১০ লক্ষ
বনাঞ্চলের ধরন ও বৈশিষ্ট্য
সামাজিক বন
সামাজিক বনায়ন ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণ সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে । জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণে যে বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়, তাকেই সামাজিক বনায়ন বলা হয় । বাংলাদেশের বন বিভাগ এরই মধ্যে উপকূলীয় চরাঞ্চলসমূহে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সৃষ্টির প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার জন্মলগ্ন থেকেই সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এতে জনসাধারণ সরাসরি অংশগ্রহণ করছে এবং উপকৃত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের প্রায় সকল সড়ক, মহাসড়ক ও রেল লাইনের পাশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়েছে। বৃক্ষ রোপণ ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সমবায় ভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রধানত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে সামাজিক বন প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ।
সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তা
১। গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্রের জন্য কাঠের জোগান দান ও জ্বালানি কাঠের ঘাটতি পূরণ ।
২। পতিত জমি, বসতভিটা, সড়ক, রেলপথ, বাঁধ, খাল বিল ও নদীর পাড়ে, বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠানে বনায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ ।
৩। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো এবং দারিদ্র বিমোচন । ৪। পশুখাদ্য, শাকসবজি, ফলমূল, ভেষজ ও বিনোদনের জন্য বন সৃজন ।
৫ । বন উৎপাদিত কাঁচামাল গ্রামীণ কুটির শিল্পে সরবরাহ করা ও জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ।
৬। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ ও মরুবিস্তার রোধ করা । ভূমিক্ষয় রোধ করা ।
৭। জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ।
কাজ- দলগত কাজ সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তার ম্যাপ পোস্টার কাগজে তৈরি কর । |
সামাজিক বন
1. দারিদ্র বিমোচন
2. জনগণের অংশগ্রহণ
বনাঞ্চলের ধরন ও বৈশিষ্ট্য : কৃষি বন
পরিবেশ বাঁচানো, জ্বালানি সরবরাহ, কাঠ ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাপী কৃষি বনের প্রসার ঘটছে । আমাদের দেশেও বর্তমানে কৃষি বনায়ন পদ্ধতির যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটছে। কৃষি বনায়ন হলো কোনো জমি থেকে একই সময়ে বা পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন গাছ, ফসল ও পশুপাখি উৎপাদন ব্যবস্থা । সাধারণভাবে কৃষি বনায়ন হচ্ছে এক ধরনের সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি । এতে কৃষি ফসল, পশু, মৎস্য এবং অন্যান্য কৃষি ব্যবস্থা সহযোগে বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ জন্মানোর ব্যবস্থা করা হয় ।
কৃষি বনায়নের বৈশিষ্ট্য
১। একই জমি বারবার ব্যবহার করে অধিক উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায় ।
২। বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও ফসলের সমাহার ঘটায় উৎপাদন ঝুঁকি কমে যায় ।
৩। খামারের উৎপাদন স্থায়িত্বশীল হয় ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে ।
৪ । সামাজিক ও পরিবেশগত গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে ।
৫। প্রান্তিক ভূমিজ সম্পদ ব্যবহার হয় ।
৬। স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারে সুযোগ থাকে ।
৭। ফসল খামার মালিক, মিশ্র খামার মালিক ও বন বাগান মালিকের চাহিদা পূরণ হয় ।
৮। কৃষি বনে উৎপাদিত দ্রব্যাদি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যায় ।
কৃষি বনায়ন : পদ্ধতি ও প্রকার
১। ফসলবন : বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গাছ ও আন্তঃফসল সমন্বয়ে গঠিত। প্রধান উদ্দেশ্য খাদ্য ও পশুখাদ্য উৎপাদন ।
২। তৃণবন : মিশ্র খামার হয়ে থাকে । প্রধান উদ্দেশ্য খাদ্য ও পশুখাদ্য উৎপাদন ।
৩। কৃষি তৃণবন : ফসলের জোড় চাষ । মাঝে মাঝে বনজ গাছের উৎপাদন করা যায় ।
৪। কৃষিবন মৎস্য খামার : মিশ্র খামার করা যায় । উঁচু নিচু জমি সমন্বয়ে খামার স্থাপন করতে হয় । ফসল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ ও মৎস্য উৎপাদন করা যায় ।
কৃষিবনের প্রয়োজনীয়তা
১। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা ।
২। খাদ্যের চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা ।
৩। ফসলি জমির বহুবিধ ব্যবহার করে উৎপাদন ঝুঁকি কমিয়ে আনা ।
৪ । বিরাট জনগোষ্ঠীর কাজের ব্যবস্থা করা ও দারিদ্র হটানো ।
৫ । এলাকাভিত্তিক কৃষি বাজার তৈরি করে গ্রামীণ জনজীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়ন ।
৬। উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার করা ।
৭। কৃষি গবেষণার ফলাফলভিত্তিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা ।
৮। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা এবং মাটিক্ষয় রোধ করা ।
৯। পশুখাদ্য উৎপাদন এবং পশু পাখি ও উপকারী কীট পতঙ্গের নিরাপদ আবাস তৈরি করা ।
১০ । পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা ।
কাজ : শিক্ষার্থীরা এককভাবে দুইটি করে বনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করবে । |
আরও দেখুন...